চোরাবালি’৭১

স্বাধীনতা (মার্চ ২০১১)

তমসা অরণ্য
  • ২৭
  • 0
  • ৫৫
(১)
দৈনিক সত্যের সন্ধানে পত্রিকার একজন নাম করা সাংবাদিক, সত্যেন সৈনিক। গত ২/৩ সপ্তাহ ধরে রাতে সত্যেনের ভাল ঘুম হচ্ছে না। অফিস থেকে আসন্ন বিজয় দিবস উপলক্ষে এসাইনমেন্ট দেয়া হয়েছে ’৭১-এর যুদ্ধশিশুদের নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করার জন্যে। নভেম্বর মাস শেষ হতে চলল, তবু কাজ তেমন এগুচ্ছে না। রিপোর্টটার এক-চতুর্থাংশ কাজই বাকি পড়ে রয়েছে। অথচ এমনটি তো কখনও হয়নি! শুধু চমৎকার রিপোর্টিংয়ের জন্যে নয়, সময় মত রিপোর্ট তৈরি করা এবং কখনও কখনও নির্দিষ্ট সময়ের আগেই রিপোর্ট তৈরি করার জন্য প্রিন্ট মিডিয়ায় তার যথেষ্ট খ্যাতি আছে। কিন্তু এবার যেন কাজ এগুতেই চাচ্ছে না। আসলে বিষয়টি নিয়ে ভাববার অনেক কিছু ছিল এবং আছে। কিন্তু স্বাধীনতার ৩৩ বছর পরও এ বিষয়টি নিয়ে তেমন কোন জোরাল তথ্যনির্ভর, পরিসংখ্যান নির্ভর এবং গবেষণাধর্মী রিপোর্টিং না হওয়ায় কিংবা কোন নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র বা রেফারেন্স বুক না থাকায় সত্যেন ঠিক কিভাবে কাজটি শেষ করবে তা বুঝে উঠতে পারছে না। যদিও রিপোর্টটা লেখার কাজ এর মধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে এবং এতটাই ভালভাবে শুরু হয়েছে যে, শুরুটা এ রিপোর্টটার একটা তথ্যপূর্ণ সমাপ্তি দাবি করতেই পারে। আর তাই সময়ের দাবিকে অস্বীকার করতে পারছে না বলেই বিষয়টি তাঁকে এতটা ভাবাচ্ছে।

(২)
গত রাতেও সত্যেনের ভাল ঘুম হয়নি। তবে রিপোর্টটার শুরুর দিকটা যতটুকু লেখা হয়েছে ততটুকুই বারবার পড়তে পড়তে, আর লেখাটা কিভাবে গুছিয়ে নেয়া যায় তা চিন্তা করতে করতেই রাত ৩টা-সাড়ে ৩টার পর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে তা সে নিজেও টের পায়নি। কিন্তু তাঁদের এপার্টমেন্ট থেকে কিছুটা দূরের মসজিদ থেকে ফজরের আযান ভেসে আসতেই তাঁর কাঁচা ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। টেবিলের উপর থেকে মাথাটা তুলতেই চোখে পড়ে রিপোর্টের কিছু কাগজ টেবিলের এদিকে-ওদিকে আর কিছু কাগজ টেবিলের নিচে ঠিক তাঁর পায়ের দিকটায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এলোমেলোভাবে পড়ে আছে। আর টেবিলে পড়ে থাকা কিছু কাগজ হাতের চাপে কুঁচকানো অবস্থায় পড়ে আছে। পড়ে থাকা কাগজগুলো তুলতে তুলতে আর কুঁচকে থাকা কাগজগুলো ঠিক করতে করতেই সত্যেন কান খাড়া করে শুনতে থাকে ফজরের আযান। যিনি আযান দিচ্ছেন, সেই ষাটোর্ধ শুভ্র দাঁড়ির লম্বা-চওড়া মানুষটি একজন মুসলমান এবং স্বয়ং মসজিদের ঈমাম হয়েও একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ। খুব কম ঈমাম সাহেবকেই এ রকম ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং অসাম্প্রদায়িক দেখেছে সত্যেন। আর তাই অমন একজন মানুষের মুখে আযানের সুমধুর ধ্বনি আর নামাজের আহবান শুনতে সত্যেনের খুব ভাল লাগে। ঈমাম মোহাম্মাদ হুজুরের মুখে আযান শুনে মনে হয় যেন আযানের প্রতিটি ধ্বনি প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে! এ যেন শুধু নামাজের জন্য এক একজন মুসলমানকে ডাকার জন্যে ডাকা কিংবা ডাকতে হয়, ডাকতে হবে বলে ডাকা নয়; বরং সত্যিকারের ঈমানদার এবং সহীহ এবাদতকারীকে নামাজের জন্য আহবান করছেন। এ যেন গোটা পৃথিবীটাকে, গোটা বাঙালি জাতিকে ঘুমন্ত অবস্থা থেকে সত্যিকারে জেগে ওঠার আহবান করছে! হুজুরের বলা শেষ কথাগুলো অর্থাৎ

“আসসালাতু খাইরুন মিনান নাওম”

-- শুনে সত্যেনের এমনটাই মনে হয়। হুজুরের কাছ থেকে এ কথার অর্থ সত্যেন জেনে নিয়েছিল। বাংলা করলে যার অর্থ দাঁড়ায়,

“ঘুম হইতে নামাজ উত্তম”।

বয়সের ভারে নূব্জ্য লম্বা-চওড়া হুজুরের কথা ভাবতেই সত্যেন অবাক হয়। সেই ছোটবেলা থেকে তাঁর সুর যেমনটা শুনে আসছে, এখনও ঠিক তেমনটিই আছে। কি আশ্চর্য সুন্দর, মধুময় সেই সুর! ভরাট গলায় হুজুর যখন আযান দেন তখন শুনলে মনে হয়, এই অনিরুদ্ধ আহবানকে উপেক্ষা করার মত মনোবল বা ব্যক্তিত্ব বোধহয় কারুরই নেই। আযান শেষ হতেই আড়মোড়া ভেঙ্গে অলস ভঙ্গিতে সত্যেন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। টেবিল ল্যাম্পের টিমটিমে আলোটাকে আরও বাড়িয়ে দিয়ে দরজার পাশের লাইটের সুইচটা অন করে দেয়। এরপর রিপোর্টের কাগজগুলো ধারাবাহিকভাবে সাজিয়ে টেবিলের এক কোণে রাখতেই, কাঁধে মায়ের আলতো হাতের স্পর্শ অনুভব করে।

“কে? মা! তুমি এত সকাল সকাল উঠলে যে? তোমার শরীরটা তো ক’দিন ধরে ভাল দেখছি না। তা তুমি আবার এই ভোরে উঠতে গেলে কেন? যাও শুয়ে পড়ো।”

সত্যেনের মা ছেলের হাত ধরে বিছানায় বসতে বসতে অভিমানের সুরে বলেন --

“হ্যাঁ, আমার অসুখ। কিন্তু তুই কি ভাবিস আমি কিছুই দেখি না? আজ ২/৩ সপ্তাহ হল তুই রাতে ঠিক মত ঘুমাস না। কোন কোনদিন সারা রাত তোর ঘরে আলো জ্বলে! ঠিক মত খাওয়া-দাওয়াও করিস না। হ্যাঁ রে খোকা, মাকে বলবি না তোর কি হয়েছে? তোর মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে, দেখেছিস?”

সত্যেনের গলায় দুষ্টুমী ঝরে পড়ে। সে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুতে শুতে আদুরে গলায় বলে --

“আমার কি দোষ বলো মা? তুমি তো এখন আর খাইয়েও দাও না, আর রাতে পিঠ চাপড়ে ঘুমও পাড়িয়ে দাও না। তাই তো আমার এই হাল!”

“ও রে দুষ্টু, এখন মাকে দোষ দেয়া হচ্ছে? বউ এলে তাঁকে বলব তোকে খাইয়ে, পড়িয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে।”

-- এই বলে মা ছেলের নাক টিপে দেন। হঠাত সত্যেন গম্ভীর হয়ে বলে --

“মা, অফিস থেকে ’৭১-এর যুদ্ধশিশুদের নিয়ে একটা রিপোর্ট লিখতে বলেছে। কিন্তু কিছুতেই কাজটা গুছিয়ে আনতে পারছি না। তাই অস্থিরতায় রাতে ঘুম আসে না, মুখে খাবার রুচে না। এমন তো কখনও হয়নি মা। যুদ্ধশিশুদের নিয়ে লিখতে ভেতর থেকে ভীষণ তাগিদ আসছে যেন! একাত্তরে জন্ম বলে হয়ত, তাই না মা?”

সত্যেন মার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে উত্তরের অপেক্ষায়।

“কি যেন, হবেও বা হয়ত!”

-- এ ক’টা শব্দ অনেক কষ্টে-সৃষ্টে যেন মার বুক চিরে দীর্ঘ নিঃশ্বাসের মত বের হয়ে আসে। এরপরই বিছানা থেকে উঠে, বাবা ডাকছেন বোধহয় বলে তড়িঘড়ি করে সত্যেনের ঘর থেকে বের হয়ে যান। সত্যেন লক্ষ করে, একাত্তর শব্দটা শুনেই মায়ের মুখ আমসি হয়ে উঠেছে। সেই ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছে, একাত্তর সংখ্যাতেই যেন মায়ের যত আপত্তি! কিছুতেই ও শব্দ শুনতে চায় না, মুখে আনতেও যেন ভয় পায়। মায়ের দু’ভাই শহীদ হয়েছেন ঐ একাত্তরে, এজন্যেই হয়ত একাত্তরে মার এত ব্যথা। তাই কখনও জানতেও চায়নি মা একাত্তর শুনলেই অমন অস্থির হয়ে উঠেন কেন। আরক্তিম মুখ হঠাতই বা কেন রক্তহীন, পান্ডুর, বিবর্ণ হয়ে ওঠে! এসব ভাবতে ভাবতেই জানালার বাইরে তাকিয়ে পুরোপুরি আলো ফুটতে দেখেই সত্যেন বিছানা থেকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দ্রুত পায়ে ছুট লাগায় হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে ফ্রিজ থেকে পাউরুটি বের করে নাস্তা সেরে মাকে না ডেকেই, প্রতিদিনের মত বাসন্তী মাসিকে দরজা লাগিয়ে দিতে বলে হাঁটতে বেরিয়ে যায়।

(৩)
সত্যেন এপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়েই সোজা মসজিদের রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করে। এরপর রাস্তাটা পাড়ার ছেলেদের খেলার মাঠটার দিকে মোড় নিতেই, সত্যেন দেখে ঈমাম মোহাম্মদ হুজুর ঐ রাস্তা ধরেই তাঁর দিকে এগিয়ে আসছেন। সত্যেনের উদ্দেশ্যও ছিল হাঁটতে হাঁটতে হুজুরকে খুঁজে বের করে, তাঁর কাছে এ ক’দিনের অস্থিরতার কথা খুলে বলা। যদি তিনি কোন পথ বাতলাতে পারেন! কিন্তু হুজুরকে খুঁজে পেতে কোন অসুবিধাই হল না, বরং মসজিদের রাস্তায় আসতে না আসতেই তাঁর দেখা পাওয়া গেল।

“আরে, সত্যেন যে! কি খবর? সব ভাল তো? তোমার চোখ দু’টো ফুলে অমন লাল টকটকে হয়ে আছে কেন? চুলগুলোও কেমন উস্কখুস্ক! কোন সমস্যা?”

“ঠিক সমস্যা নয়, আবার সমস্যাও বলতে পারেন। হুজুর, আমি আজ আপনাকে খুঁজতেই বেরিয়েছিলাম। ভাল হল আপনার সাথে দেখা হয়ে।”

“এসো, আমরা সামনে এগুতে এগুতে কথা বলি। তুমি চাইলে তোমার সমস্যা বলতে পারো। যদি পারি তো নিশ্চয়ই তোমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করব।”

সত্যেন হাঁটতে হাঁটতে বলতে শুরু করে --

“হুজুর, গত ২/৩ সপ্তাহ হল অফিস থেকে যুদ্ধশিশুদের নিয়ে রিপোর্ট করার দায়িত্ব পেয়েছি। কিন্তু উপযুক্ত তথ্যের অভাবে লেখাটা ঠিক এগুতে পারছি না। অথচ নভেম্বর শেষ হয়ে ডিসেম্বর হতে চলল। ডিসেম্বরের ১০ তারিখের মধ্যে রিপোর্ট সাবমিট করার কথা। কি করি বলুন তো!”

হুজুর বেশ গম্ভীর ভঙ্গিতে কতক্ষণ চিন্তা করে, সত্যেনের কাঁধে হাত রেখে একটু নিচুগলায় বললেন --

“আমি তোমাকে আমার পরিচিত একটা এতিমখানার ঠিকানা দিতে পারি। অবশ্য এতদিনে সেটা ওখানে আছে কিনা তা আমার জানা নেই। গ্রামটা অনেক দূরের, আর দূর্গম এলাকা তো... তাই যাতায়াত ব্যবস্থাও বেশ কষ্টকর। সেখানে ’৭১-রে বহু যুদ্ধশিশু ও তাঁদের মায়েদেরকে আমি এবং আমার সহযোদ্ধারা রেখে এসেছিলাম। ওখানে খুঁজে, তুমি তোমার প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য হয়ত পেয়েও যেতে পারো! অন্তত দু’একজন যুদ্ধশিশু কিংবা যুদ্ধ-বিপর্যস্ত পরিবারের সাথে অভিজ্ঞতা-অনুভূতি বিনিময় তো করতে পারবে।”

সত্যেনের জানা ছিল না হুজুর একজন মুক্তিযোদ্ধা। আর তাই আজ জানতে পেরে গভীর শ্রদ্ধায় হুজুরের প্রতি তাঁর মাথা কৃতিজ্ঞতাভারে নত হয়ে আসে। হুজুরকে ধন্যবাদ দিয়ে, অধরাকে ধরার সম্ভাবনায় আনন্দিত হয়ে সত্যেন কৃতজ্ঞতায় ভরা উচ্ছ্বাসে বলল --

“হুজুর, আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দিবো! আপনি এই সাহায্যটা করে আমার অস্থির মনটাকে শান্ত করলেন। কোন যুদ্ধশিশু কিংবা যুদ্ধ-বিপর্যস্ত পরিবারের সাথে যোগাযোগ করার বুদ্ধি তো আমার মাথায় এর আগে আসেইনি! আপনি বলায় মনে হচ্ছে, ব্যাপারটি আমার রিপোর্টিংয়ের কাজে বেশ উপকারে আসবে।”

এরপর হুজুরের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে এবং হুজুরের লেখা একটা চিঠি নিয়ে, সত্যেন বাড়িতে মাকে অফিসের কাজে ২/৩ দিনের জন্য ঢাকার বাইরে যাবার কথা বলে, অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ঠিকানায় লেখা গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।

(৪)
ঢাকা থেকে প্রথমে বাসে, তারপর টেম্পোতে, এরপর আবারও বাসে, তারপর ট্রলারে, শেষে পায়ে হেঁটে কিছুদূর গিয়ে নৌকায় করে সত্যেন ঠিকানায় থাকা গ্রামে গিয়ে পৌঁছল। সেখানে লোকজনকে জিজ্ঞাসা করতে করতে ঠিকানানুযায়ী এতিমখানাটির দিকে এগুতে লাগল। কিছু দূর যেতেই দেখে, এতিমখানা! হুজুর বলেছিলেন, এতিমখানার জমিটা ছিল বিরাট। কিন্তু বোঝা গেল, প্রভাবশালীদের দাপটে তা অনেক সংকুচিত হয়ে এসেছে। ভবিষ্যতে হয়ত অস্তিত্বটুকুও খুঁজে পাওয়া যাবে না! টিনের জীর্ণ ছাউনী আর ভাঙ্গাচোরা ইটের দেয়ালের তৈরি এতিমখানার ঘরগুলোর বেহাল দশা দেখে এমন কথাই মনে হল সত্যেনের। এসব ভাবতে ভাবতেই সে এতিমখানার ভেতরে গিয়ে, প্রধানের দায়িত্বে থাকা মোঃ আব্দুল করিম মোল্লার সাথে দেখা করে হুজুরের লেখা চিঠি দিয়ে নিজের পরিচয় দিল। হুজুরের চিঠি পড়া শেষ হলে, মোল্লা সাহেব এতিমখানার একজন শিক্ষকের ঘরে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। আর রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষে সত্যেনের চাহিদানুযায়ী এতিমখানাটিতে এ পর্যন্ত যত ছেলেপিলে এসেছে বা এসেছিল, তাঁদের সব রেজিষ্টার খাতা নিয়ে এলেন। সত্যেন সেখান থেকে বেছে ’৭১-এর রেজিষ্টার খাতা দু’টি বের করে দেখে সেখানকার সিংহভাগ যুদ্ধশিশুকেই দেশি-বিদেশি বহু দম্পতি দত্তক নিয়ে গেছেন। আর যে ক’জন এতিমখানার হেফাজতে ছিল, তাঁরা বেশিরভাগই প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে নিজ নিজ গন্তব্য নির্ধারণ করতে জীবন ও জীবিকার খোঁজে পথে-প্রান্তরে বেরিয়ে পড়েছে। রেজিষ্টার খাতায় দত্তক নেয়া যুদ্ধশিশুদের পালক বাবা-মার ঠিকানা পাওয়া গেছে, কিন্তু এতিমখানার হেফাজতে থাকা শিশুগুলোর কোন ঠিকানাই সেখানে নেই। অবশ্য দু’তিনজন যুদ্ধশিশু এ এতিমখানারই শিক্ষক হিসেবে একসময় দায়িত্ব পালন করে আসছিল। তবে স্থানীয় রাজাকারদের দাপটে তাঁরাও গ্রামছাড়া হতে বাধ্য হয়েছে। সব কিছু মোল্লা সাহেবের মুখে শুনে সত্যেন অনেকটাই হতাশ হল। কিন্তু তারপরও সারারাত ধরে যুদ্ধের সময়কার কথা, মোহাম্মাদ হুজুরের সাহসিকতার কথা, তাঁদের রেখে যাওয়া বীরাঙ্গনা মা আর যুদ্ধশিশুদের কথা, বিভিন্ন পরিবারের দত্তক নিতে আসার ঘটনা, বীরাঙ্গনা মা-বোনদের প্রকৃত পরিবারের কথা, তাঁদেরকে পরিবার থেকে নিতে অস্বীকার ও লাঞ্ছনার-গঞ্ছনার কথাসহ একাত্তরের নানা স্মৃতি কথাগুলো মোল্লা সাহেবের মুখে শুনে সত্যেন আবারও নতুন আশায় বুক বাঁধলো। এতিমখানায় বসেই সে রাতে লিখে ফেলল অসমাপ্ত রিপোর্টের আরও অনেকখানিকটা! পরদিন সকালে এতিমখানার সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এবং মোল্লা সাহেবের দেয়া চিঠি নিয়ে সত্যেন ঢাকায় ফিরে আসলো।

(৫)
সত্যেন ঢাকায় ফিরেই একদিন বিশ্রাম নিয়ে আবারও ব্যস্ত হয়ে পড়ল তাঁর রিপোর্টিংয়ের কাজে। এরপর এতিমখানার রেজিষ্টার খাতা থেকে তুলে আনা ঠিকানাগুলো থেকে বেছে বেছে ঢাকার আশেপাশে থাকা ঠিকানা থেকে ৮/১০টা ঠিকানা আলাদা কাগজে তুলে নিলো। ঠিকানা অনুযায়ী ৫/৬টা বাড়িতে গিয়ে দেখল, দত্তক নেয়া পরিবারগুলো আর আগের ঠিকানায় নেই। কোথায় থাকে তাও কেউ বলতে পারল না। নাহ, আবারও হতাশা ঘিরে ধরে সত্যেনকে!
তবে কি সত্যিই তাঁর লেখাটা শেষ করা সম্ভব হবে না?

(৬)
আজও প্রতিদিনের মতই ভোর না হতেই ঘুম থেকে উঠে পড়ে সত্যেন। এরপর ব্যাগের ভেতর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ঢুকিয়ে, নাস্তা সেরেই বেরিয়ে পড়ল রেজিষ্টার খাতা থেকে তুলে আনা ধানমন্ডির মি. এন্ড মিসেস রাশেদ নামক দত্তক নেয়া দম্পতির বাসার ঠিকানায়। ধানমন্ডিতে একটু ঘোরাঘুরি করতেই ঠিকানানুযায়ী বাড়ির খোঁজ মিলল। কিন্তু এ যে বিশাল বড়লোকের বাড়ি, সুউচ্চ এপার্টমেন্ট! অবশ্য ঠিকানায় লেখা রাশেদ দম্পতি এ বাড়িতে এখনও থাকেন কিনা সেটা ভেবেই আশা-নিরাশার দোলাচালে দুলতে দুলতে সত্যেন গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কলিংবেল টিপতেই একজন দশাসই পালোয়ান টাইপ খাকি পোশাক পড়া দারোয়ান গেটের পাশে থাকা ছোট্ট একটা রুমের ফাঁকা দিয়ে পরিচয় জানতে চাইল। সত্যেন নিজেকে সাংবাদিক বলে পরিচয় না দিয়ে মি. এন্ড মিসেস রাশেদ দম্পতির সাথে দেখা করার কথা বলে, নিজেকে সেই গ্রাম্য এতিমখানা-প্রধান মোল্লা সাহেবের পাঠানো লোক বলে পরিচয় দিল। দারোয়ান তাঁকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেই ফোনে সম্ভবত, রাশেদ দম্পতির সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয়ে নিল। এরপর দারোয়ান তাঁকে ৭ নম্বর ফ্লোরের ডি ব্লকের ৪ নম্বর ফ্ল্যাটে তাঁরা আছেন বলে জানাল এবং গেটের ভেতর ঢুকতে দিল। সত্যেন লিফটে করে গিয়ে ৪ নম্বর ফ্ল্যাটের বেল টিপল। বেল টিপতেই একজন কাঁচা-পাকা চুলের বয়স্কা মহিলা দরজা খুলে দিলেন। তারপর ড্রয়িংরুমে বসতে বলে ভেতরের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। সত্যেন ঘুরে ঘুরে ড্রয়িংরুমের চারপাশটা খুব ভাল করে দেখছিল। রুমটিতে আভিজাত্য, সৌখিনতা ও রুচিশীলতার ছাপ স্পষ্ট। হঠাতই বাঁ দিকটার দেয়ালে চোখে পড়ল কিছু পারিবারিক অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি এবং একটি হাস্যোজ্জ্বল শিশুর চমৎকার কিছু ছবি। অবশ্য ড্রয়িংরুমে ঢোকার আগেও দরজা দিয়ে ফ্ল্যাটটির ভেতরে ঢোকার পথে দেয়ালে এরকম আরও বেশ কিছু ছবি দেখে এসেছে সে। সত্যেন খুঁটে খুঁটে ছবির শিশুটিকে দেখছিল আর অনেক কিছু ভাবছিল, এমন সময় --

“ওটা আমার একমাত্র ছেলের ছবি...”

-- বলতে বলতেই ঘরে ঢুকলেন সাদা চুল-দাঁড়ির পাঞ্জাবী পড়া একজন ভদ্রলোক। ভদ্রলোকের কথা শুনতে পেতেই সত্যেন ইতস্তত ভঙ্গিতে পেছন ফিরে তাকাল।

“তা আপনি কোথা থেকে এসেছেন যেন..? ওহ স্যরি, গার্ড বলছিল.. সোনাপুর গ্রাম থেকে.. তাই না?”

-- বলতে বলতে ভদ্রলোক সত্যেনকে সোফায় বসতে ইশারা করলেন। সত্যেন ধন্যবাদ জানিয়ে বসল। এরপর মোল্লা সাহেবের লেখা চিঠিটা তাঁর হাতে দিলে, চিঠিটা পড়তে পড়তে তিনি কেমন যেন গম্ভীর হয়ে উঠলেন। মুখে এখন আর সেই বিনয়ী হাসিটা নেই। সত্যেন ভেতরে অস্থির হয়ে উঠলেও মুখে তা প্রকাশ করল না, শান্ত ভঙ্গিতে ইতিবাচক একটা কিছু শোনার আশায় মি. রাশেদের দিকে তাকিয়ে বসে রইল। কিন্তু মি. রাশেদ এ ব্যাপারে সত্যেনকে সহযোগিতা করতে কোন মতেই রাজি হলেন না, বরং প্রথমে সরাসরি অস্বীকার করলেন। সত্যেনও অনেক করে, নানাভাবে তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করল। শেষে যখন আশা ছেড়ে দিচ্ছিল তখন বিভিন্ন যুক্তি-তর্ক, মোল্লা সাহেবের চিঠির কথা, হুজুরের সেদিনগুলোর কথা, তাঁর সোনাপুরে যাবার কথাসহ নানা কথা শোনানোর পর অনেক কষ্টে রাজি করাতে পারল। তবে শর্ত একটাই, আর তা হল -- সত্যেন তাঁদের কোন তথ্য, নাম বা কথা সরাসরি এমনভাবে ব্যবহার করতে পারবে না; যাতে বোঝা যায় যে, তাঁরা কারা এবং কি তাঁদের পরিচয়।

সেদিনের পর, সত্যেন প্রায়ই তাঁদের বাড়িতে যায় তথ্য সংগ্রহ করার কাজে এবং যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধ-পরবর্তী নানা অভিজ্ঞতা, কাহিনী জানতে। তাঁরর সাথে প্রায়ই দত্তক নেয়া সেই যুদ্ধশিশু; আজ যে তাঁরই বয়েসী, সেই ছেলেটির সাথে দেখা হয়ে যেত। সত্যেনের মত একজন অপরিচিত আগন্তুককে বাড়িতে রোজ যাতায়াত করতে দেখে, প্রায়ই সামনা-সামনি দেখা হয়ে যাওয়া আর তাঁর বাবা-মার সাথে সত্যেনের কথা-বার্তার কিছু কিছু শুনে ফেলার ফলে একদিন ছেলেটি জেনে ফেলল, সে একজন যুদ্ধশিশু এবং মি. এন্ড মিসেস রাশেদ তাঁর আপন বাবা-মা নন। এরপর সে কোথায় যে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল! কোথায় গেছে তা কেউই বলতে পারল না। এসবই ঘটে গেছে একদিন সত্যেন প্রতিদিনের মত মি. রাশেদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর। তার ২/১ দিন পর লেখাটা অর্ধেক জমা দেয়া যায় কিনা, এ কাজে অফিসে যাওয়াসহ হঠাত বেশ কিছু জরুরী কাজ পড়ে যাওয়ায় সেই বাড়িতে তাঁর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। কিন্তু পরদিন গিয়ে দূর্ঘটনাবশত ঘটে যাওয়া ঘটনাটি শুনে হতভম্ব হয়ে পড়ল। ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখল পুরো বাড়িটাই যেন মরা বাড়ি, আত্মীয়-স্বজনে ঘর ভরে গেছে। অথচ কোথাও কোন কোলাহল নেই। শুধু থেকে থেকে শোবার ঘরে মিসেস রাশেদের কান্নাজড়ানো আর্ত-চিতকার আর মূর্ছা যাবার শব্দ শোনা যাচ্ছে। সত্যেন ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই দেখে, মি. রাশেদ মাথা নিচু করে বসে আছেন। তাঁর বয়স যেন আরও ২০ বছর বেড়ে গেছে! কপালে চিন্তার বলিরেখা, মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। সত্যেনকে দেখেই ভদ্রলোক চিৎকার করে উঠলেন --

“খবরদার, আর এক পাও এগুবেন না। বেরিয়ে যান এ বাড়ি থেকে। আমাদের একা থাকতে দিন, ফর গড সেইক... জাস্ট লিভ আস আলোন...”

মি. রাশেদের ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখে সত্যেন অবাক হয়ে গেল। কারণ, তখনও সে ঘটনার কিছুই জানে না। তবে থমথমে পরিবেশ দেখে বুঝতে পারছিল, গুরুতর কিছু ঘটে গেছে। হতে পারে তা মৃত্যু কিংবা অন্য কিছু। তবে মৃত্যুর চেয়েও যে কত বড় ভয়ঙ্কর প্রলয় এ পরিবারের উপর দিয়ে বয়ে গেছে তা সে ভাবতেও পারেনি। হঠাত সত্যেনের আসার খবর শুনে মিসেস রাশেদ উন্মাদের মত ড্রয়িংরুমে ছুটে এসে বলতে শুরু করলেন --

“আমার ধ্রুব, আমার ধ্রুব... আমার ধ্রুবকে এনে দাও। ও কি হারিয়ে গেছে?”

সত্যেনের শার্টের কলার চেপে এই কথাগুলো বলতে বলতেই তিনি অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন। দু’জন মহিলা এসে তাঁকে ধরাধরি করে তুলে নিয়ে যাবার সময়, এতক্ষণে সত্যেন অঘটনের আঁচ পেল। মাথা নত করে বেরিয়ে আসার জন্যে এগুতেই মি. রাশেদ পেছন থেকে কান্না জড়ানো কন্ঠে মেঘের দামামা বাজিয়ে বলে উঠলেন --

“দাঁড়ান সত্যেন বাবু, বলেছিলেন... সত্যকে আলোর মুখ দেখাতে হবে। যুদ্ধশিশুদেরকে তাঁদের প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু... এ কেমন সত্য দেখালেন? এ কেমন সম্মান দিলেন! যার কারণে আজ একটা সাজানো-গোছানো সংসার ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল। আমার ধ্রুব আমাদেরকে অস্বীকার করে তাঁর শেকড় খুঁজতে নিরুদ্দেশ হল, কেন বলতে পারেন? আপনার আলো হয়ত সত্যের মুখ দেখবে। কিন্তু আলো কি সত্যি সত্যি কোন দিন সত্যের জীবনকে উদ্ভাসিত করতে পারবে? কই, আপনাদের সো কলড আলো তো আমাদের ধ্রুব সত্যকে অন্ধকারেই ঠেলে দিল। এ কেমন সত্য?”

-- মি. রাশেদ কথাগুলো বলেই প্রবল আক্রোশে ঠাস করে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। আর আমাদের সত্যেন সৈনিক এতদিনের ধামাচাপা দিয়ে রাখা সত্যকে প্রকাশ করার গর্ব নিয়ে নয়, বরং একটা সত্যকে মিথ্যা না করতে পারার অপরাধবোধ নিয়ে আহত সৈনিকের চেয়েও ব্যথাতুর, পরাজিত সৈনিকের চেয়েও গ্লানিকর হৃদয়ে পালাবার পথ খুঁজলেন।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফাতেমা প্রমি অসাধারণ...গল্প বলবার প্রক্রিয়াটাই পাঠককে সামনে এগিয়ে নেয়...অনেক unique idea...সত্য কে এভাবে প্রকাশের ক্ষমতাও সবার নেই-যেন রাজাকার টাকেই ইমাম/মুসলিম পরিচয়বাহি হতে হবে...এই ব্যাপারটা সত্যি ভাল লেগেছে... যদিও এটাই এই সমাজের reality - কিন্তু তবুও ধ্রুব কে তো ফিরিয়ে আনতে পারতেন,না?? ও কেন চলে যাবে?
বিষণ্ন সুমন অনেক ভালো লিখেছেন. আমার লিখাগুলু পড়বার আমন্ত্রণ থাকলো.
Azaha Sultan ভালো, খুব ভালো লাগলো...
তমসা অরণ্য বন্ধু মুস্তাগির (বানান ভুল হলে ক্ষমাপ্রার্থী), চেষ্টা থাকবে.. ধন্যবাদ!
মোঃ মুস্তাগীর রহমান তোমার লেখা আমাকে ভাল লাগল।সামনে দিনে লিখবে..............
তমসা অরণ্য বন্ধু সাইফুল, মোহাম্মদ হুজুর আমারও খুব প্রিয় ১টি চরিত্র। অবহেলা? তাই কি! এলেও.. সচেতনভাবে তা আসেনি। আপনার মতটা আমারও বেশ লাগল। কিন্তু.. আমি চেয়েছি.. সত্য প্রকাশের যে বিড়ম্বনা তা তুলে ধরতে। আপনার গঠনমূলক মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ!
বিন আরফান. যদি এই গল্পটা প্রথম হত আমার খব ভাল লাগত. শুভ কামনা রইল.
তমসা অরণ্য বন্ধু আমাতে যখন আমি, ধন্যবাদ!
তমসা অরণ্য বন্ধু আরাফাত, ধন্যবাদ!

০৯ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪